রাশিয়া কি যুদ্ধের পথে যাচ্ছে?

এপ্রিলের শুরু থেকেই ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী মোতায়েনের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। অনেকেই এটিকে নতুন করে সহিংসতা শুরুর আভাস হিসেবে দেখছেন। 

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক বছর ধরে সুপ্ত অবস্থায় থাকার পর গত মার্চ মাস থেকেই পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘাত হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রুশ সৈন্য সমাবেশ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সৈন্য সমাবেশের উদ্দেশ্য কি? 

রাশিয়া বলছে, ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সামরিক বাহিনী মোতায়েনের পেছনে মূল কারণ হলো- ইউক্রেনের মাটিতে ন্যাটোর সামরিক মহড়া এবং হুমকি। রুশ সরকারি টেলিভিশনে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বক্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। 

এই উত্তেজনার মাঝেই ১৩ এপ্রিল হোয়াইট হাউস জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে কয়েক মাসের মধ্যে তৃতীয় কোনো দেশে দু’জনের এক শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন। অনেক ইস্যুর মাঝে বাইডেন ইউক্রেনের বিষয়েও কথা বলেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর। একই দিনে ক্রেমলিন থেকেও এই ফোনালাপের কথা জানানো হয়। 

ডয়েচে ভেলের রাশিয়া-বিষয়ক বিশ্লেষক কনস্টানটিন এগার্ট বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাইডেন ও পুতিনের এই খেলায় বাইডেনই প্রথম চোখের পলক ফেলেছেন। তিনি কিছুদিন আগেও পুতিনকে ‘খুনি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। কনস্টানটিন এগার্ট প্রশ্ন তোলেন- এখন ফোন করে তিনি কি দুর্যোগ আটকালেন, নাকি বড় কোনো ছাড় দিলেন? তবে শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা রুশ সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। কারণ তা পুতিনের জন্য রাষ্ট্রনায়কোচিত হবে না। তবে যেহেতু বাইডেন প্রথমে এই বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাই পুতিন সে ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে থাকবেন। 

পুতিনের সঙ্গে বাইডেনের ফোনালাপের পরদিন তুর্কি কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্র দুটি যুদ্ধজাহাজের বসফরাস প্রণালি অতিক্রমের জন্য তুরস্কের কাছে যে অনুমতি চেয়েছিল, তা তারা বাতিল করেছে। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি জানায়, সামনের দিনে নতুন করে কোনো যুদ্ধজাহাজের বসফরাস অতিক্রমের অনুমতিও চাওয়া হয়নি। 

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তুরস্কের কর্মকর্তারা হয়তো বুঝতে পারেননি যে, জাহাজগুলো মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত কখনোই নিশ্চিত করা হয়নি। অপরদিকে তুরস্ক বলছে, মার্কিনিরা ১৫ দিন আগেই ‘মনট্রিউ কনভেনশন’ অনুযায়ী তুর্কি সরকারকে জানিয়েছিল যে, জাহাজগুলো ১৪ বা ১৫ এপ্রিল বসফরাস অতিক্রম করবে এবং ৪ মে পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগরে থাকবে। ১৯৩৬ সালের এই কনভেনশন অনুযায়ী, কৃষ্ণ সাগরের দেশ নয় এমন কেউ কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করতে গেলে কমপক্ষে ৮ দিন আগে তুরস্ককে জানাতে হবে। আর একসঙ্গে ৯টির বেশি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা যাবে না, যেগুলো সর্বমোট ১৫ হাজার টনও অতিক্রম করতে পারবে না। আর কোনো জাহাজ ১০ হাজার টনের চেয়ে বড় হতে পারবে না। বিদেশি যুদ্ধজাহাজ কৃষ্ণ সাগরে ২১ দিনের বেশি থাকতে পারবে না। তবে রাশিয়া নিজেই সাম্প্রতিককালে এই কনভেশনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে।

মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের অধ্যাপক মিখাইল ট্রইটস্কির মতে, রাশিয়া পশ্চিমাদের সঙ্গে পুরো ভূরাজনৈতিক খেলাটিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে চাইছে। বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা অবরোধের জবাব দিতে চাইছে রাশিয়া। পশ্চিমারা যেমন বলছে- রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের মূল্য দিতে হচ্ছে, তেমনি রাশিয়াও বলতে চাইছে- তারাও পশ্চিমাদের কর্মকাণ্ডের ওপর মূল্য নির্ধারণ করতে পারে। যদিও এতে রাশিয়ার ওপর অবরোধ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের প্রধান আন্দ্রেই করতুনোভের মতে, রাশিয়ার জনগণ এখন তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়েই জর্জরিত। করোনাভাইরাস, অর্থনৈতিক অবরোধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতন রাশিয়ার অর্থনীতিকে ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে। এমতাবস্থায় একটি বড় সামরিক মিশন রাশিয়ার জন্য বাহুল্যই বটে। 

তিনি আরো বলেন, ইউক্রেন সরকার পূর্বের সীমান্ত অঞ্চলে নিজেদের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করেছে। রুশরা সীমান্তে সামরিক শক্তি মোতায়েন করে ডনবাসে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর নতুন করে যুদ্ধ শুরুর চিন্তাকে প্রতিহত করতে চাইছে। মার্কিন ও ইউরোপীয়রা সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাশিয়া খুব সম্ভবত ইউক্রেন আক্রমণ করবে না। কারণ রুশ কৌশল হলো- পূর্ব ইউক্রেনে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা ও ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ব্যাপক সমস্যার ফলশ্রুতিতে কিয়েভে রাজনৈতিক গোলযোগের অপেক্ষা করা। ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক হামলা রাশিয়াকে কিছুই দেবে না।

রুশ সিনেটর কনস্টানটিন কসাচেভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে, সামরিক দিক থেকে রাশিয়াকে অতিক্রম করা সম্ভব নয় এবং দুই দেশের আলোচনায় ফেরত আসা ছাড়া গতি নেই। তার কথায় এটুকু বোঝা যায়, রাশিয়া মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চাইছে, যার প্রস্তাব বাইডেন ইতিমধ্যে ফোনালাপের মাধ্যমে দিয়েছেন। 

মার্কিন থিকট্যাঙ্ক সিএনএ করপোরেশনের ডিরেক্টর মাইকেল কফম্যান দ্য মস্কো টাইমসে প্রকাশিত এক লেখায় বলেন, রাশিয়ার সমরশক্তি মোতায়েন মূলত ভীতি প্রদর্শনের জন্য, দেখানোর জন্য। কারণ ইউক্রেনে সামরিক হামলা করে রাশিয়ার কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে না। 

বিবিসি এক বিশ্লেষণে জানায়, সাত বছর আগে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনে তার সামরিক শক্তি প্রেরণ করে তা অস্বীকার করেছিল, এখনো করছে। সেটি ছিল রাশিয়ার গোপন অপারেশন; কিন্তু এবারে তারা বড়সড় আয়োজন করে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করছে। রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের ভালোবাসা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে; বরং তারা চাইছে- পশ্চিমারা রাশিয়াকে ভয় করুক। আর তাই রাশিয়া এবার সৈন্য পাঠায়নি, বার্তা পাঠিয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //